[১৯৯১ সালের ২৫শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠে নওদাপাড়া আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীর দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ময়দানে* অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর দু’দিনব্যাপী ২য় জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমায় সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও (তৎকালীন) কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও সুধী পরিষদের মাননীয় আমীর জনাব মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রদত্ত উদ্বোধনী ভাষণ]
আসসালা-মু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লা-হি ওয়া বারাকা-তুহু
নাহমাদুহু ওয়া নুছাল্লী ‘আলা রাসূলিহিল কারীম
‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর জাতীয় সম্মেলন ১৯৯১ ও তাবলীগী ইজতেমার সম্মানিত সভাপতি, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম, সুধীমন্ডলী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হ’তে আগত ভাই ও ভগিনীগণ এবং আহলেহাদীছ আন্দোলনের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তরুণ কর্মী ও সাথীবৃন্দ!
১৯৮০ সালের ৫ ও ৬ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকাতে অনুষ্ঠিত আহলেহাদীছ যুবসংঘের ১ম আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঐতিহাসিক জাতীয় সম্মেলনের দীর্ঘ এগার বছর পরে বাংলাদেশের সর্বাধিক আহলেহাদীছ অধ্যুষিত যেলা রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে আজকের অভূতপূর্ব সম্মেলনে মিলিত হ’তে পেরে আমরা সর্বপ্রথমে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বলি ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এই স্থানেই ১৩৫৫ সালের ২৮শে ফালগুন মোতাবেক ১৯৪৯ সালের ১২ই মার্চ শনিবার ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলেহাদীছ’-এর ১ম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল।[1] সেদিন সেই কনফারেন্স অনুষ্ঠানের মেযবানের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন নওদাপাড়া এলাকার আহলেহাদীছ জনগণ। আজও ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ২য় জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমার মেযবানের মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রাজশাহী ও নওদাপাড়া এলাকার ভাইগণ তাঁদের পুরানো ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন- এজন্য তাঁদেরকে জানাই অসংখ্য মুবারকবাদ। আল্লাহ পাক যেন আমাদের সকলের এই খালেছ দ্বীনী খিদমত কবুল করেন এবং ইহকাল ও পরকালে সর্বোত্তম জাযা প্রদান করেন-আমীন!!
বন্ধুগণ! উদ্বোধনী ভাষণের শুরুতে আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশ অঞ্চলে আহলেহাদীছ আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টিকারী খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ্ব হ’তে শতবর্ষ ব্যাপী পরিচালিত জিহাদ আন্দোলনের মহান নেতৃবৃন্দকে। আমি স্মরণ করি সম্ভবতঃ ১৮২২ সালে হজ্জের সফরে বাংলাদেশ অঞ্চলে পদার্পণকারী ইতিহাসের অমর নায়ক সাইয়িদ আহমদ ব্রেলভী (১২০১-১২৪৬হিঃ/১৭৮৬-১৮৩১খৃঃ) ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬হিঃ/১৭৭৯-১৮৩১খৃঃ)-এর নিকট থেকে আন্দোলনের দায়িত্ব লাভকারী মহান সংগঠক চাঁপাই নবাবগঞ্জের পাকা নারায়ণপুরের কৃতি সন্তান বহরমপুর জেলের বীর কয়েদী রফী মোল্লাকে ও তাঁর পাঁচজন মুজাহিদ শাগরিদ, পুত্র মৌঃ আমীরুদ্দীন নারায়ণপুরী, মৌঃ আসীরুদ্দীন নারায়ণপুরী, মৌঃ আব্দুল করীম বাসুদেবপুরী, মৌঃ আব্দুল কুদ্দূস মোল্লাটুলী ও মৌঃ ইব্রাহীম মন্ডল দিলালপুরী প্রমুখ আহলেহাদীছ আন্দোলনের মহান পূর্বসূরীদেরকে। আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি জিহাদ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের বীর সেনাপতি পাটনার মাওলানা এনায়েত আলীকে (১২০৭-১২৭৪হিঃ/১৭৯২-১৮৫৮খৃঃ), যিনি দু’বারে প্রায় একযুগ ধরে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা এবং বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে ও পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনা ও মালদহ অঞ্চলে ব্যাপক দাওয়াত ও জিহাদের প্রচার চালিয়ে শিরক ও বিদ‘আত অধ্যুষিত অত্র এলাকাসমূহে হেদায়াতের আলো জ্বেলে ছিলেন। যাঁর উত্তরসূরী হিসাবে পরবর্তীকালে আমীরুল মুজাহিদীন আমীর আব্দুল্লাহর (১২৭৮-১৩২০হিঃ/১৮৬২-১৯০২খৃঃ) নির্দেশক্রমে কুমিল্লার বুড়িচং উপযেলার পারুয়ারা গ্রামের মুজাহিদ সন্তান মাওলানা আকরাম আলী খান (১৮৫৫-১৯৩৭খৃঃ) বর্তমান পাকিস্তান ও আফগান সীমান্ত অঞ্চলের মূল মুজাহিদ কেন্দ্র ‘আসমাস্ত’ হ’তে রাজশাহীর দুয়ারীতে এসে ১৯০০ খৃষ্টাব্দে জিহাদের অন্যতম কেন্দ্র গড়ে তোলেন, যা আজকের সম্মেলন স্থল হ’তে মাত্র তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
আমরা স্মরণ করব মাওলানা এনায়েত আলীর অন্যতম খলীফা সপুরা মিয়াঁপাড়ার স্বনামধন্য নেতা ঝাবু সরদার ও ঝাগু সরদার নামক প্রভাবশালী দু’ভাইকে। যাঁদের প্রচেষ্টায় রাজশাহীতে ৩৬ জাতির হিন্দু সবাই মুসলমান হয়ে যায় এবং রাজশাহী শহরে আহলেহাদীছ জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হয়। যাঁর পুত্র মাওলানা গাযী মুনীরুদ্দীনের আমলে বর্তমান সপুরা সরকারী হাউজিং এষ্টেটের দখলীভুক্ত ২৪ বিঘা জমির উপরে বিরাট মাদরাসা বনাম মুজাহিদ ট্রেনিং ও রিক্রুটিং সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যাঁদের প্রতিষ্ঠিত জামে মসজিদটি এখন রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে পরিত্যক্ত মসজিদ হিসাবে বর্তমান আছে।[2]
আমরা স্মরণ করব মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর (১২২০-১৩২০হিঃ/১৮০৫-১৯০২খৃঃ) কীর্তিমান ছাত্র রাজশাহীর জামিরা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কারামাতুল্লাহ ও তৎপুত্র মাওলানা মুহাম্মাদ ও তাঁদের সম-সাময়িক যমুনা পারের মৌলভী এলাহী বখ্শ শরীফপুরী (জামালপুর), মৌলভী নে‘মাতুল্লাহ বর্ধমানী (চাপড়া, বাঘমারা, রাজশাহী), মৌলভী ইসহাক দৌলতপুরী (কুষ্টিয়া), মৌলভী আসীরুদ্দীন নদীয়াভী (মালদহ) প্রমুখ ওলামায়ে কেরামকে, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দাওয়াত ও তাবলীগের ফলে বৃহত্তর রাজশাহীর বিস্তীর্ণ এলাকায় আহলেহাদীছ আন্দোলন যোরদার হয় ও অগণিত মানুষ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়ায় উদ্বুদ্ধ হন, ফালিল্লা-হিল হাম্দ। এছাড়াও স্মরণ করি বাংলার গ্রামে-গঞ্জের জানা-অজানা অসংখ্য মুজাহিদ, গাযী ও শহীদানকে, যাঁদের জান ও মালের অতুলনীয় ত্যাগের ফলেই এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নির্ভেজাল ইসলামের এ মহান আন্দোলন।
অতঃপর আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করব ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র এককালের তরুণ ছাত্র কর্মী ঢাকার সাজ্জাদুল করীম ও টাংগাইলের আবুল কাসেম-এর প্রতি। ১৯৮০ সালের জুন মাসে কবরপূজার বিরুদ্ধে ‘যুবসংঘে’র মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় কবর পূজারীদের হামলায় ঢাকার রাজপথে যাদের প্রথম রক্ত গড়িয়েছিল। আমরা শ্রদ্ধা জানাই কুমিল্লার ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সেই তরুণ তিনটি ভাইকে[3], ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে যারা চক্রান্তকারীদের হামলায় পিষ্ঠ হয়। ফয়যুল নামের ১৫ বছরের তরুণ ভাইটির মলদ্বার দিয়ে কুলু কুলু বেগে রক্ত প্রবাহিত হয় এবং হাসপাতালে ২৬ ঘণ্টা অজ্ঞান থেকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসে। এমনিভাবে গত দু’বছরে অলস মস্তিষ্ক নেতাদের দ্বারা অপমানিত ও বিভিন্নমুখী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা আজও হচ্ছেন, অথচ অসীম ধৈর্যের সাথে আহলেহাদীছ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সেই সকল কর্মী ও উপদেষ্টা ভাইদের প্রতি রইল আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম দো‘আ। বিশেষ করে সাবেক কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও আজকের প্রধান অতিথি ভাই আব্দুল মতীন সালাফীর কথা বলতে আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, যাঁকে এই সব তথাকথিত নেতাদের ষড়যন্ত্রে মাত্র তিন ঘণ্টার সরকারী নোটিশে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।[4] আল্লাহ পাক যেন আমাদের সকল প্রকার ত্যাগ ও কুরবানীর উত্তম জাযা ইহকাল ও পরকালে দান করেন-আমীন!
পরিশেষে আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হ’তে আগত ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ ও ‘আহলেহাদীছ মহিলা সংস্থা’র আন্দোলন পাগল ভাই-বোন ও তাদের শুভাকাংখী মুরব্বিয়ান ও অন্যান্য সুধী মন্ডলীকে এবং শ্রদ্ধেয় ওলামায়ে কেরামকে, যাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত আগমনে রাজশাহী মহানগরীর জনপদ আলোড়িত ও আমোদিত হয়েছে এবং বাংলাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনে নতুন জোয়ারের শুভ সূচনা ঘটেছে।
হে আল্লাহ! আমাদের প্রত্যেক ভাই ও বোনের নিঃস্বার্থ দ্বীনী খিদমত যা কেবলমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হয়েছে, তুমি তা কবুল কর এবং ইহকাল ও পরকালে জাযায়ে খায়ের আতা কর- আমীন! ইয়া রববাল ‘আলামীন!!
* বর্তমানে উক্ত স্থানের উপর দিয়ে রাজশাহী মহানগরী নওদাপাড়া বাইপাস (আমচত্বর) সড়ক নির্মিত হয়েছে -প্রকাশক।
১. গৃহীত: এসতেকবালিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল হামীদের লিখিত অভিভাষণ এবং ‘আহলেহাদীস পরিচিতি’ পৃঃ ৪৪ ও ১১০; উক্ত অভিভাষণ থেকে জানা যায় যে, ঐ দিন কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর (১৮৭৬-১৯৪৮খৃঃ) নামানুসারে নওদাপাড়ার নাম ‘জিন্নাহ নগর’ রাখা হয়। বর্তমানে উক্ত স্থানে হামীদপুর নওদাপাড়া পাইলট স্কুল, গার্লস স্কুল ও নওদাপাড়া বাজার জামে মসজিদ স্থাপিত হয়েছে।
২. ১৯৯২ সালের প্রথম দিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। যার অনতিদূরে মাননীয় লেখক-এর উদ্যোগে তাঁর সংগঠন কর্তৃক ১৯৯৪ সালে আলীশান সপুরা মিয়াঁপাড়া আহলেহাদীছ জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে -প্রকাশক।
[3]. ফয়যুল ইসলাম ( গোয়ালজুর, কানাইঘাট, সিলেট), রুস্তম আলী (জগৎপুর, কুমিল্লা), আব্দুল কবীর (ভৈষেরকুট, কুমিল্লা)। ঘটনাস্থল: দেবীদ্বার উপযেলাধীন ভৈষেরকুট প্রাইমারী স্কুলের সম্মুখে, ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে। এরা তখন জগৎপুর মাদরাসার ছাত্র ও যুবসংঘের ‘কর্মী’ ছিল। উক্ত স্থানে তারা মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানীর জালসায় ওয়ায শুনতে এসেছিল।
[4]. আব্দুল মতীন সালাফী (১৯৫৪-২০১০ খৃঃ) সঊদী সরকারের অধীনে চাকুরীরত মাবঊছ হিসাবে ১লা জানুয়ারী ১৯৮০ হ’তে ২রা জুলাই ১৯৮৯ পর্যন্ত ৯ বছর ৭ মাস ২ দিন বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। এই সময় তিনি ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীস’-এর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘের’ কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান ভারতের পশ্চিম বঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর যেলার করণদীঘি থানার অন্তর্গত ভুল্কী গ্রামে। বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে বিহারের কিষাণগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে খাগড়া এলাকায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য বিশাল দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং সমাজ কল্যাণে ব্যাপক অবদান রাখেন। ২০১০ সালের ১৬ই জানুয়ারী শনিবার কিষাণগঞ্জে নিজবাড়ীতে তিনি ৫৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং নিজ গ্রাম ভুলকীতে সমাহিত হন। =দ্রঃ মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী ১৩/৫ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী’১০।