মানুষের
মধ্যে তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি বাধ্যতা ও অবাধ্যতা দু’টি প্রবণতা রয়েছে।
শয়তান দ্বিতীয় প্রবণতাকে উস্কে দিয়ে তাকে তার প্রতিপালকের আনুগত্য হ’তে বের
করে নেয়। তখন তার মধ্যে মুক্তকচ্ছ ব্যক্তির মত সাময়িকভাবে এক ধরনের
স্বেচ্ছাচারিতার সুখানুভূতি সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরক্ষণেই সে হতাশার
কৃষ্ণগহবরে নিক্ষিপ্ত হয়। অতঃপর তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সাগরে লক্ষ্যহীন জীবনতরী
নিয়ে যত্রতত্র ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তার বাউন্ডুলে জীবনের অবসান ঘটে।
প্রাপ্তির ঝুলিতে অপ্রাপ্তির বেদনা ছাড়া তার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে
না। বস্ত্ততঃ শয়তানের উদ্দেশ্য হ’ল সেটাই।
পক্ষান্তরে আরেক দল মানুষ তার স্বভাবধর্ম অনুযায়ী স্বীয় পালনকর্তার বিধান মেনে জীবন যাপন করে এবং আখেরাতে সর্বোত্তম পারিতোষিক লাভের উদগ্র বাসনা নিয়ে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এরা শয়তানের প্রতারণা বুঝতে পারে এবং নিজেকে তার খপ্পর থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হয় আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে।
উক্ত দু’দল মানুষের দু’টি করে বৈশিষ্ট্য ও দু’রকম পরিণতি ব্যাখ্যা করে আল্লাহ বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষ তার কৃতকর্মসমূহ স্মরণ করবে’ (৩৫) ‘এবং দর্শকের জন্য জাহান্নামকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে’ (৩৬)। ‘তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে’ (৩৭) ‘এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে’ (৩৮) ‘জাহান্নাম তার ঠিকানা হবে’ (৩৯)। ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করেছে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামী হ’তে বিরত রেখেছে, (৪০) ‘জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৩৫-৪১)।
আমাদের আদি পিতা আদম ছিলেন মানব জাতির প্রথম নবী। তিনি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করেছেন ও সন্তানদের সেভাবে পরিচালিত করেছেন। এতদসত্ত্বেও ধর্মের বিধান লংঘন করে পুত্র ক্বাবীল তার ছোট ভাই হাবীলকে হত্যা করে ভাল-র প্রতি হিংসা বশতঃ। এভাবেই ধর্মহীনতা ও ধর্মপরায়ণতার সংঘাত মানব সৃষ্টির প্রথম যুগ থেকেই চলে আসছে।
আধুনিক যুগের সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ উক্ত ধর্মহীনতার মন্দ প্রবণতা হ’তে উৎসারিত। যেখানে ধর্মের কোন নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতা নেই। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর খ্রিষ্টবাদের প্রতি বিদ্বেষ থেকে আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের গোড়াপত্তন ঘটে। যেখানে ধর্মের চাইতে বস্ত্তকে মুখ্য হিসাবে তুলে ধরা হয়। ঊনবিংশ শতকে এসে যা একটি আন্দোলনে রূপ নেয়। বৃটিশ সেক্যুলারিস্ট জ্যাকব হলিওক ১৮৫১ সালে প্রথম ‘সেক্যুলারিজম’ নামকরণ করেন।
বস্ত্ততঃ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ হ’ল মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত। পক্ষান্তরে ইসলাম হ’ল আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’। যা মানবজাতির কল্যাণের জন্য প্রেরিত সর্বশেষ এলাহী দ্বীন বা সরল পথের নাম। যা সত্য, শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়। জীবন তরঙ্গে যা মানুষকে সর্বদা সঠিক ও নিশ্চিত ঠিকানার সন্ধান দেয়। ফলে বিশ্বাসী মানুষের জন্য এপথে কোন অনিশ্চয়তার অন্ধকার নেই। এ পথে চললে সে সফলকাম। না চললে সে ব্যর্থকাম। দু’টির মাঝে তৃতীয় কোন পথ নেই। যদি কেউ সে পথ তালাশ করে, তবে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। থিসিস, এন্টি থিসিস আর সিনথেসিসের গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে সে জীবনপাত করবে। কিন্তু প্রকৃত সত্যের সন্ধান সে পাবে না আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত। অথচ ইসলামের পথ স্বচ্ছ ও আলোকময়। যে কেউ এপথ থেকে বিচ্যুত হবে, সে ধ্বংস হবে। মানবজাতির বিগত ও বর্তমান ইতিহাস তার জাজ্বল্যমান নযীর।
আলোচ্য বইয়ে আমরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে’র অশুভ পরিণতি এবং ইসলামের সাথে এর বৈপরীত্য তুলে ধরেছি। যাতে সত্যিকারের কোন সত্যসন্ধানী ব্যক্তি এর ধোঁকায় না পড়ে এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অনুসারী হয়ে তার সার্বিক জীবন অতিবাহিত করে। আল্লাহ হেদায়াতের মালিক। আমরা কেবল তাঁরই করুণার ভিখারী। তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা এবং তাঁর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের প্রতি সকল দরূদ ও সালাম।