ইসলামের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হ’ল এটি সুস্পষ্ট দলীলের উপর প্রতিষ্ঠিত
ধর্ম। কোন অস্পষ্টতা বা সংশয়ের অবকাশ এতে নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি
তোমাদের মাঝে এমন একটি দ্বীন বা শরী‘আত রেখে যাচ্ছি, যার রাত তার দিনের মতই
উজ্জ্বল। আমার পরে একান্ত ধ্বংসকামী ব্যতীত এই দ্বীন ছেড়ে কেউই বক্রপথ
অবলম্বন করবে না’ (ইবনু মাজাহ হা/৪৩)। আর সুস্পষ্ট দলীল বা
শরী‘আতের মূল ভিত্তি হ’ল কুরআন এবং হাদীছ, যে দু’টির অনুসরণ মুসলিম উম্মাহর
জন্য অপরিহার্য। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে
দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা এ দু’টি বস্ত্তকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে,
ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এক. আল্লাহর কিতাব এবং দুই. রাসূল (ছাঃ)-এর
সুন্নাহ (মুওয়াত্ত্বা হা/৩; মিশকাত হা/১৮৬)। যিনি নিজেকে মুসলিম
হিসাবে দাবী করবেন, তার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হ’ল কুরআন ও হাদীছকে
শিরোধার্য হিসাবে গ্রহণ করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে এতদুভয়ের অনুসরণ
নিশ্চিত করা। যদি কোন মুসলমান নীতিগতভাবে এই বিষয়টি স্বীকার না করে, তবে
নিঃসন্দেহে সে পথভ্রষ্ট হবে এবং ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাবে। এ বিষয়ে
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোন দ্বিমত নেই।
প্রাথমিক যুগে ছাহাবী এবং তাবেঈগণ রাসূল (ছাঃ) থেকে প্রাপ্ত হাদীছসমূহ নিঃশর্তভাবে অনুসরণ করতেন, যদি বর্ণনাকারীগণ ধীশক্তিসম্পন্ন এবং ন্যায়পরায়ণ হতেন। তারা হাদীছের উপর আমল করার ক্ষেত্রে এমন কোন পার্থক্য করতেন না যে হাদীছটির বিষয়বস্ত্ত আক্বীদাগত নাকি আহকামগত। তারা এমন কোন শর্তারোপ করতেন না যে, হাদীছটি একজন বর্ণনা করেছেন নাকি একটি বড় সংখ্যক দল বর্ণনা করেছেন। বরং বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত হ’লে তথা বিশ্বস্তসূত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর কোন হাদীছ পেলেই তারা হাদীছটিকে আবশ্যকভাবে আমলযোগ্য মনে করতেন। কিন্তু পরবর্তী যুগসমূহে মুসলিম সমাজে যখন যুক্তিবিদ্যা এবং গ্রীক দর্শনের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন এমন কতিপয় দল-উপদলের সৃষ্টি হয়, যারা হাদীছের মধ্যে এই পৃথকীকরণ শুরু করে। বিশেষতঃ আক্বীদাগত ক্ষেত্রে তারা খবর ওয়াহিদ তথা একক সূত্রে বর্ণিত হাদীছকে আমলযোগ্য নয় বলে মত পোষণ করতে থাকে। শুধু তাই নয় ক্ষুদ্র একটি দল তো গোটা হাদীছ শাস্ত্রকেই অস্বীকার করে বসে এবং আক্বীদা ও আহকাম কোন ক্ষেত্রেই হাদীছ শরী‘আতের কোন দলীল নয় মর্মে ঘোষণা করে। পূর্বযুগে এই দলটি কেবল তার আবির্ভাবকাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমান যুগে বিশেষত সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে পুনরায় এই ধারণার উদ্ভব হয়েছে এবং তা যথেষ্ট বিস্তৃতিও লাভ করেছে। আর এর পশ্চাতে প্রতিনিয়ত জ্বালানী সরবরাহ করে চলেছেন প্রাচ্যবিদ অমুসলিম গবেষকগণ। ফলে এক শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে এ বিষয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি তৈরী হয়েছে।
অন্যদিকে ফিকহী মাযহাবগুলোও বিভিন্ন যুক্তিভিত্তিক ক্বিয়াসী মূলনীতি তৈরী করার মাধ্যমে অনেক হাদীছ পরিত্যাগ করেছে, যা কি না মুহাদ্দিছদের মূলনীতিতে ছহীহ বলে সাব্যস্ত। পরবর্তীতে তাক্বলীদী বেড়াজালে আবদ্ধ একশ্রেণীর মাযহাবী ওলামায়ে কেরামও তাক্বলীদের নামে নিজেদের মতবিরুদ্ধ হাদীছগুলোর উপর আমল পরিত্যাগ করেছেন। যা প্রকারান্তরে হাদীছের প্রতি তাদের অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এই বিভ্রান্তি থেকে মুসলিম সমাজকে সতর্ক করার জন্য ১৯৭২ সালে স্পেনের গ্রানাডায় অনুষ্ঠিত এক ছাত্র সম্মেলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ও সারগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। পরবর্তীতে তাঁর এই বক্তব্যকে লিখিত রূপ দেয়া হয়। পুস্তিকাটির গুরুত্ব বিবেচনায় ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ বাংলা ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকার (মার্চ-ডিসেম্বর ২০১৮ খৃ.) সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয়। ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী’র সাবেক ছাত্র, ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এবং বর্তমানে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি গবেষণারত মীযানুর রহমান বইটি সাবলীলভাবে অনুবাদ করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ গবেষণা বিভাগ কর্তৃক সম্পাদিত ও পরিমার্জিত হওয়ার পর বইটি প্রকাশ হতে যাচ্ছে। বইটি প্রকাশের সাথে জড়িত সকলের প্রতি আন্তরিক মোবারকবাদ রইল। আল্লাহ আমাদের সকলের নেক প্রচেষ্টা সমূহকে কবুল করুন। আমীন!