home

call

email

লেখকের নিবেদন

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله وحده والصلاة والسـلام على من لا نبيّ بعده وعلى آله وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلي يوم الدين وبعد :

১৯০৯ সালে ইহূদী নেতারা ৩৪তম ওছমানীয় খলীফা ২য় আব্দুল হামীদের (১৮৭৬-১৯০৯ খৃ.) নিকট বহুমূল্য উপঢৌকনের বিনিময়েও যখন ফিলিস্তীন তাদের অধিকারে নিতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেওয়া বস্ত্তবাদী মতাদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে তরুণ শ্রেণী ও দুর্বলচেতা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করে। সেনাবাহিনীর মধ্যে গ্রুপিং করে। তখন থেকেই খেলাফতের আনুষ্ঠানিক পতন শুরু হয়ে যায়। যার প্রতিবাদে ভারতে মাওলানা শওকত আলী (১৮৭৩-১৯৩৯) ও তার ছোট ভাই মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর (১৮৭৮-১৯৩১)-এর নেতৃত্বে ১৯১৯ সালে ‘খেলাফত আন্দোলন’ (১৯১৯-১৯২৪ খৃ.) গড়ে ওঠে।[1] ঐ সময় এমনকি মি. গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) সহ হিন্দু নেতারাও বৃটিশ বিরোধিতার স্বার্থে ‘খেলাফত আন্দোলন’-কে সমর্থন করেন। 

অবশেষে ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ বিশ্বাসঘাতক প্রধান সেনাপতি মুছতফা কামালের হাতে ৩৭তম ও সর্বশেষ খলীফা ২য় আব্দুল মজীদ (১৯২২-১৯২৪)-এর পতনের মাধ্যমে ৬৬২ বছরের ঐতিহ্যবাহী ওছমানীয় খেলাফত (৬৮০-১৩৪২ হি./১২৮১-১৯২৪ খৃ.) বিলুপ্ত হয়। এর ফলে মুসলমানদের রাজনৈতিক ঐক্য শেষ হয়ে যায়।

নিজেদের ঈমানী দুর্বলতা ও পারস্পরিক স্বার্থদ্বন্দ্ব এবং ইহূদী-খৃষ্টানদের চক্রান্তই ছিল খেলাফত বিলুপ্তির কারণ। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ একই রোগে আক্রান্ত। একই চক্রান্তের শিকার হয়ে তারা আজ ইসলামী খেলাফতের স্বপ্ন ছেড়ে কুফরী রাষ্ট্র কায়েমে জান-মাল উৎসর্গ করছে। ফলে স্লাইস্ড পাউরুটির ন্যায় টুকরা টুকরা হওয়া ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র কার্যতঃ অমুসলিমদের গোলামী করছে। সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব না হ’লেও পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে যদি ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তাহ’লে সেটিই হবে বিশ্ব মানবতার জন্য সত্যিকারের আদর্শ রাষ্ট্র। এই স্বপ্ন নিয়েই আগামী দিনের তরুণদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মানুষের দাসত্ব ছেড়ে আল্লাহর দাসত্বে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আল্লাহ কবুল করলে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশেও সেটি সম্ভব হ’তে পারে।

জানা আবশ্যক যে, ইসলাম যেমন সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। ইসলামী খেলাফত তেমনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত। আর এজন্য মুসলিমরাই হবেন অগ্রসৈনিক।      

বাংলাদেশ ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ। ইসলামের বিধান মতেই এদেশ চলবে এটাই কাম্য। এর কল্যাণ স্পর্শে দেশ নবজীবন লাভ করবে এবং সর্বদা উন্নতি ও অগ্রগতির পথে থাকবে। সেজন্য আমাদের কর্তব্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে দৃঢ়চিত্ত আল্লাহভীরু একজন ‘খলীফা’ বা ‘আমীর’ নির্বাচন করা। যিনি আল্লাহর বিধান মতে দেশ পরিচালনা করবেন।

হযরত ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি তোমাদের অছিয়ত করছি আল্লাহভীরুতার এবং আমীরের আদেশ শ্রবণ ও তাঁর আনুগত্য করার। যদিও তিনি হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে তোমরা যারা বেঁচে থাকবে, তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে। সে অবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নাত ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা। তোমরা সেগুলি আঁকড়ে ধরবে ও মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। আর তোমরা অবশ্যই নবোদ্ভূত বস্ত্ত সমূহ হ’তে বিরত থাকবে। কেননা ইসলামে সকল প্রকার নবোদ্ভূত বস্ত্ত বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’। ‘আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[2] একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আমি তোমাদেরকে স্বচ্ছ দ্বীনের উপর রেখে যাচ্ছি। যার রাত্রি হ’ল দিবসের ন্যায়। আমার পরে যে ব্যক্তি উক্ত দ্বীন থেকে বিচ্যুত হবে, সে ধ্বংস হবে’।[3] উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ের আলোকে অত্র বইয়ে ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচনের বিধি-বিধান সমূহ বর্ণিত হয়েছে।

মাসিক আত-তাহরীক মার্চ ২০০০, ৩/৬ সংখ্যায় ‘ইসলামী খেলাফত’ এবং মে ২০০০, ৩/৮ সংখ্যায় ‘নেতৃত্ব নির্বাচন’ শিরোনামে ‘দরসে কুরআন’ কলামে নিবন্ধ দু’টি প্রকাশিত হয়। অতঃপর দু’টি নিবন্ধ একত্রিত করে ‘ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন’ নামে মার্চ ২০০৩-য়ে বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় (পৃ. ৪৮)। ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নানাবিধ কারণে বইটির পুনঃপ্রকাশ দেরী হয়। বর্তমানে বইটির কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। যা পাঠকের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ

পরিশেষে অত্র বইটি প্রকাশে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর গবেষণা বিভাগের সংশ্লিষ্ট ও সহযোগী সকলকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে দীন লেখকের ও তার মরহূম পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততিদের জন্য অত্র লেখনী পরকালীন নাজাতের অসীলা হৌক, এই প্রার্থনা করছি- আমীন!

নওদাপাড়া, রাজশাহী                                                বিনীত

২৬শে এপ্রিল ২০২১ সোমবার।                                      -লেখক।

১৪৪২ হিজরী।

 

[1]. ১৯৩০ সালের ১২ই নভেম্বর ভারতের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে আহুত লন্ডনের গোল টেবিল বৈঠকে মাওলানা মুহাম্মাদ আলী বলেন, ‘আমি শুধু একটি উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছি। তা এই যে, আমি মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাই আযাদীর পরওয়ানা হাতে নিয়ে। কোনো পরাধীন ভূখন্ডে আমি ফিরে যাব না’। পরে ১৯৩১ সালের ৪ঠা জানুয়ারী লন্ডনেই তাঁর মৃত্যু হয়। লন্ডনের ভক্তরা তাঁকে সেখানেই দাফন করতে চান। অন্যদিকে ভারতের ভক্তদের দাবী ছিল তার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তাঁর জন্য অবশেষে বরাদ্দ হ’ল পবিত্র ভূমি বায়তুল মুক্বাদ্দাসের ‘কুববাতুছ ছাখরা’র নিকটবর্তী স্থান। যে বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখলের জন্য ইহূদী-খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদীরা ওছমানীয় খেলাফত ধ্বংস করেছিল। ইতিপূর্বে তার মা কারা ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে দুই সন্তানকে বলেছিলেন, আমি পরাধীন সন্তানদের নয়, স্বাধীন সন্তানদের বুকে নিতে চাই’। লন্ডনে গোল টেবিল বৈঠকে থাকা অবস্থায় মাওলানা মুহাম্মাদ আলী একদিন সেখানকার শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরীতে গিয়ে সমস্ত তাকের উপরে রক্ষিত একটি বইকে লক্ষ্য করে সেটা পড়তে চাইলেন। তখন লাইব্রেরীয়ান তাকে বলেন, আপনিতো মুসলমান। আর ওটাতো আপনার ঘরের কিতাব, আল-কুরআন। মুহাম্মাদ আলী বললেন, এটার জন্য আপনাদের এখানে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন কেন? জবাবে লাইব্রেরীয়ান বলেন, This is the Fountainhead of all sciences. এটি হ’ল সকল বিজ্ঞানের উৎসমূল’ (ঐ, জীবনী)

[2]. عَنْ عِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ قَالَ صَلَّى لَنَا رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- الْفَجْرَ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ قُلْنَا أَوْ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا. قَالَ : أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عَبْداً حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفاً كَثِيراً، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- وفى رِوايةٍ للنسائِىِّ : وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِي النَّارِ- আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; আহমাদ হা/১৭১৮৪; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; নাসাঈ হা/১৫৭৮; মিশকাত হা/১৬৫ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ-৫; ছহীহাহ হা/২৭৩৫।

[3]. ...قَالَ : قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا، لاَ يَزِيغُ عَنْهَا بَعْدِي إِلاَّ هَالِكٌ... ইবনু মাজাহ হা/৪৩, রাবী ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ); আহমাদ হা/১৭১৮২; ছহীহাহ হা/৯৩৭।

সূচীপত্র

ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন
উপসংহার
ইসলামে নেতৃত্ব নির্বাচন : এক নযরে
জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাব সমূহ