বিচ্ছিন্ন
জনগণ যখন একক লক্ষ্যে একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তাকে জনশক্তি
বা সংগঠন বলা হয়। দাওয়াত এককভাবে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সংগঠন ব্যতীত সমাজ
পরিবর্তন ও দ্বীন কায়েম সহজ হয় না। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মক্কা
থেকে বিতাড়িত হন, তখন পার্শ্ববর্তী হিতাকাংখী বাদশাহ নাজাশীর দেশে হিজরত না
করে আল্লাহর হুকুমে ইয়াছরিববাসীদের নিকট হিজরত করেন। কারণ আগেই সেখানকার
কিছু যুবক হজ্জের মৌসুমে মক্কায় এসে তাঁর নিকট আনুগত্যের বায়‘আত নিয়েছিলেন।
অতঃপর সেখানে গিয়েই তিনি ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ বাস্তবায়নে সক্ষম হন।
রাসূল (ছাঃ) মাক্কী জীবনের ১৩ বছর দুর্বল ও নির্যাতিত ছিলেন। অতঃপর মাদানী
জীবনের ১০ বছর সবল ও বিজয়ী ছিলেন। কিন্তু উভয় জীবনে তিনি আনুগত্য পাওয়ার
হকদার ছিলেন।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা নিয়েই ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ যাত্রা শুরু করেছিল। আজও তার মুরববী সংগঠন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এবং তার অঙ্গসংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহ একই লক্ষ্যে সমাজ সংস্কারের কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সকল কর্ম আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তিনি সবকিছু দেখছেন এবং তাঁর কাছেই আমরা উত্তম বিনিময় কামনা করি।
বস্ত্ততঃ লক্ষ্যের ঋজুতা, অঙ্গীকারের দৃঢ়তা ও নেতা-কর্মীদের অবিরত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন ঐসব মুমিনকে, যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে সারিবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছফ ৬১/৪)। এতে পরিষ্কার যে, জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যতীত সমাজ সংশোধন ও পরিচালনা সম্ভব নয়। আর তা পরিচালিত হবে একজন আমীরের মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের’ (নিসা ৪/৫৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (আমীরের নিকট থেকে) আনুগত্যের হাত ছিনিয়ে নিল, ক্বিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায় যে, তার (মুক্তির জন্য) কোন দলীল (ওযর) থাকবে না। আর যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ তার গর্দানে আনুগত্যের বায়‘আত নেই, সে জাহেলী (পথভ্রষ্ট) হালতে মৃত্যু বরণ করল’ (মুসলিম হা/১৮৫১)।
শয়তানের বিরামহীন ওয়াসওয়াসার মধ্যে এই নিখাদ আন্দোলনে কর্মীদের টিকে থাকার জন্য স্রেফ আল্লাহর নামে বায়‘আতবদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। ইয়াকূব (আঃ) তাঁর ছেলেদের নিকট থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ ব্যতীত অন্য কোন পথ খুঁজে পাননি (ইউসুফ ১২/৬৬)। একইভাবে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর অনুসারীদের নিকট থেকে কেবল জান্নাতের বিনিময়ে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করতেন। কারণ এখানে কোন দুনিয়াবী স্বার্থ থাকেনা। আর আল্লাহ মুমিনের জান-মাল সবকিছু জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নেন’ (তওবা ৯/১১০)।
এই ইমারতের অধীন কর্মীগণ জান্নাত লাভের উদগ্র বাসনা নিয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানতে আমীরের নিকট আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। যাকে বায়‘আত বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা তোমার নিকটে আনুগত্যের বায়‘আত করল, তারা আল্লাহর নিকটেই বায়‘আত করল। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপরে রয়েছে। অতঃপর যে ব্যক্তি বায়‘আত ভঙ্গ করে, সে নিজের ক্ষতির জন্যই সেটা করে। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, আল্লাহ শীঘ্র তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন’ (ফাৎহ ৪৮/১০)। উক্ত বায়‘আত ও অঙ্গীকার যিনি পূর্ণ করেন, আল্লাহ তাকে পরকালীন সফলতার সুসংবাদ দান করেছেন। আর সেটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবা ৯/১১০)। যা দুনিয়াবী বিজয়ের শর্তাধীন নয়।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বত্র নেতৃত্ব ও আনুগত্য রয়েছে। যা ব্যতীত সবই অচল। সেই সাথে রয়েছে আনুগত্যের বিশ্বস্ততার জন্য শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা। রয়েছে শপথ ভঙ্গে শাস্তির ব্যবস্থা। তেমনি সুশৃংখলভাবে সংগঠন পরিচালনা ও সমাজ সংস্কারের গুরু দায়িত্ব পালনের স্বার্থে রয়েছে আমীরের নিকট আল্লাহর নামে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণের ব্যবস্থা। যা সাধারণ অঙ্গীকারের ঊর্ধ্বে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত। তাই এর গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেশী।
উল্লেখ্য যে, সফরের বা তিনজনের আমীর এবং সংগঠনের আমীর এক নয় এবং সেখানে বায়‘আত গ্রহণ যরূরী নয়। কারণ এগুলি ক্ষুদ্র পরিসরে অস্থায়ী ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদিও সেখানে আনুগত্য আবশ্যক। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, সফরের সাময়িক ও অল্প সংখ্যক সাথীদের মধ্যে একজনকে নেতা নির্বাচনের আদেশ দানের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ) সমাজের অন্য সকল ক্ষেত্রে নেতা নির্বাচন ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে উম্মতকে তাকীদ করেছেন’ (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৮/৩৯০)।
অতএব পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়া ও বৃহত্তর সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের জন্য আমীরের নিকট আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করা আবশ্যক। যা ফিরক্বা নাজিয়াহ গঠনে সহায়ক হয়। এ আনুগত্যে নেকী লাভ হয় এবং অবাধ্যতা গোনাহের কারণ হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল’ (বুখারী হা/৭১৩৭; মুসলিম হা/১৮৩৫ (৩৩)। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৩৪)। বস্ত্ততঃ আনুগত্যহীন সংগঠন ইসলামে কাম্য নয়।
আলোচ্য বইটি উক্ত লক্ষ্যে সহায়ক মনে করে আমরা তা অনুবাদ ও প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই সাথে ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’ বইটি এবং ‘থিসিস’ গ্রন্থের ‘ইমামত ও ইমারত-এর মাসআলা’ অনুচ্ছেদটি (৩৬৫-৩৬৭ পৃ.) টীকা সহ পাঠ করার জন্য সুধী পাঠকবৃন্দের প্রতি অনুরোধ রইল।
বইটি ১৯৮৮ সালের শেষ দিকে প্রথম আমাদের হাতে আসে। এতে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ চারজন আহলেহাদীছ আলেমের লিখিত চারটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে আমাদের তৎকালীন ছাত্র ও ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ‘কর্মী’ (বর্তমানে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর শূরা সদস্য) শেখ মুহাম্মাদ রফীকুল ইসলাম-কে দিয়ে ঐ সময় অনুবাদ করাই। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছর পর ছাপতে গিয়ে সেই পান্ডুলিপিটি আর খুঁজে না পাওয়ায় গবেষণা সহকারী স্নেহাস্পদ ছাত্র নূরুল ইসলাম-কে দিয়ে পুনরায় বইটি অনুবাদ করাই এবং সম্পাদনা করি। যা মাসিক আত-তাহরীক-এর ফেব্রুয়ারী’১৬ থেকে মে’১৬ পর্যন্ত পরপর চার সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আমরা উভয় অনুবাদকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এছাড়া অন্যান্য মূল্যবান বই সমূহ বাংলায় অনুবাদের জন্য সবাইকে ‘লিল্লাহ’ এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি।
পরিশেষে বিচ্ছিন্ন ঈমানদার সমাজ যাতে দ্রুত ঈমানী নেতৃত্বের অধীনে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে সার্বিক জীবনে ‘তাওহীদে ইবাদত’ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় রত হয়, আল্লাহর নিকট সেই প্রার্থনা করি।
গবেষণা বিভাগ ও প্রকাশনার সাথে জড়িত সকলকে আল্লাহ ইহকালে ও পরকালে উত্তম জাযা দান করুন -আমীন!