হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, মিলন ও বিচ্ছেদ মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য সাথী। সবকিছুকে সমন্বয় করেই মানুষ তার মৃত্যুর চূড়ান্ত ঠিকানার দিকে এগিয়ে চলে। এভাবে চলার পথে তার জীবনের চাকা যাতে পথ হারিয়ে গতিহীন হয়ে না পড়ে, সেজন্য সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে সরল পথের সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ প্রেরিত হয়েছে। সেই পথনির্দেশ বা হেদায়াত মেনে চললে জীবনের গাড়ী সঠিক পথে চলবে। নইলে পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংস হবে।
মানুষের পারিবারিক জীবন দু’জন অচেনা নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি কৌশলের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ও ভালোবাসার অদৃশ্য বন্ধন দৃঢ় হয়। আর তার মাধ্যমে মানুষের বংশ বৃদ্ধি হয়। বস্ত্ততঃ সৃষ্টির স্বাভাবিক গতি হ’ল সেটাই। কিন্তু কখনো কখনো সেখানে ঘটে যায় ব্যত্যয়। যার পরিণতিতে আসে বিচ্ছেদ। যেটি আল্লাহর কাম্য নয়। কিন্তু তিনি সেটা হ’তে দেন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও তার সুস্থ জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এবং তা থেকে অন্যদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য।
আল্লাহর অপসন্দনীয় বস্ত্ত সমূহের অন্যতম হ’ল স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ বা ‘তালাক’ ব্যবস্থা। তিনি তালাককে সিদ্ধ করেছেন এবং তার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী প্রদান করেছেন। সেই নিয়মের বাইরে গেলেই দেখা দেয় বিপত্তি। পারিবারিক জীবনে নেমে আসে অশান্তি। বস্ত্ততঃ প্রত্যেক ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকে। তালাক ও তাহলীল অমনিভাবে দু’টি ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার নাম। তিন তালাক তিন মাসে ভেবে-চিন্তে না দিয়ে এক মজলিসে একসাথে তিন তালাক বায়েন দেওয়ার মন্দ প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে হারামকে হালাল করার নোংরা কৌশল হিসাবে ‘তাহলীল’ বা হিল্লা প্রথা। জাহেলী যুগের আরবরা এ কাজ করত। ইসলাম এসে তা নিষিদ্ধ করে। অথচ উম্মতের কিছু বিদ্বানের ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে সেই ফেলে আসা জাহেলিয়াত পুনরায় মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। যা অদ্যাবধি টিকে আছে স্রেফ মাযহাবী গোঁড়ামীর কারণে। ফলে অসংখ্য মুসলিম নারী-পুরুষ আজ এই অন্যায় ও অত্যাচারী প্রথার অসহায় শিকার হচ্ছে।
বক্ষমান নিবন্ধে আমরা এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা পেশ করেছি। যাতে মানুষ জানতে পারে যে, প্রচলিত ‘হিল্লা বিবাহ’ কখনোই ইসলামী প্রথা নয়। বরং এটি জাহেলী কুপ্রথা মাত্র। যার মূলোৎপাটন করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য অবশ্য করণীয়।[1]
নিঃস্বার্থ এ লেখনীকে আল্লাহ নাচীয লেখকের ও তার পরিবারবর্গের এবং তার মরহূম পিতা-মাতার জান্নাতের অসীলা হিসাবে কবুল করুন! অনিচ্ছাকৃত ভুল সমূহের জন্য সর্বদা ক্ষমাপ্রার্থী।
পরিশেষে অত্র বইটি প্রকাশে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর গবেষণা বিভাগের সংশ্লিষ্ট ও সহযোগী সকলকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ তাদেরকে ইহকালে ও পরকালে উত্তম জাযা দান করুন- আমীন!
নওদাপাড়া, রাজশাহী বিনীত-
২৭শে অক্টোবর ২০২০ মঙ্গলবার। লেখক।
[1]. ২০০০ সালের ২রা ডিসেম্বর নওগাঁ যেলার বদলগাছী থানার ‘চকআতিথা’ গ্রামে হিল্লা-র একটি ঘটনা ঘটে। যা নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হাইকোর্ট ‘হিল্লা’সহ সকল প্রকারের ফৎওয়া অবৈধ ও দন্ডনীয় অপরাধ বলে রায় দেয় (রিট আবেদন নং ৫৮৯৭/২০০০, রায় ১.১.২০০১ খৃ.)। এ সময় আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরি এবং তা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অতঃপর ‘তালাক’ ও ‘হিল্লা প্রথা’ নামে মাসিক আত-তাহরীক গবেষণা পত্রিকার ৪র্থ বর্ষ ৫ম সংখ্যায় ফেব্রুয়ারী ২০০১-য়ে ‘দরসে কুরআন’ ও ‘দরসে হাদীছ’ কলামে আমাদের দু’টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বর্তমান বইটি মূলতঃ উক্ত নিবন্ধদ্বয়ের সমষ্টি। দুর্ভাগ্য, এরপরেও দেশে ‘হিল্লা’ চলছে। যা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় আসে। সচেতন মুমিনদের উচিত এর বিরুদ্ধে সর্বত্র সোচ্চার হওয়া। -লেখক।