home

call

email

মাওলানা আহমাদ আলী

মাওলানা আহমাদ আলী

মাওলানা আহমাদ আলী

মাওলানা আহমাদ আলী ছিলেন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একজন খ্যাতনামা আলেম, সাহিত্যিক ও সমাজসেবক এবং সুবক্তা। আদর্শ শিক্ষক হিসাবে তিনি সুনাম অর্জন করেন। সারাজীবন তিনি খুলনা ও যশোর জেলার সর্বসাধারণের শিক্ষার উন্নতির জন্য মাদরাসা, মসজিদ, স্কুল, পাঠাগার ইত্যাদি গড়ার কাজে অতীবাহিত করেছেন।


পারিবারিক পরিচিতি

তিনি বর্তমান খুলনা বিভাগের অন্তর্গত সাতক্ষীরা জেলা শহরের আলীপুর ইউনিয়নভুক্ত বুলারাটি গ্রামের সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবার "মৌলভী বাড়ী"তে বাংলা ১২৯০ সাল মোতাবেক ১৮৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মুনশী যিনাতুল্লাহ এবং মাতার নাম ছিল জগৎ বিবি। ব্যক্তিজীবনে তাঁর প্রথমে উম্মে কুলছূম এবং পরবর্তীতে বছীরুন্নেছার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। দুই স্ত্রীর গর্ভে তাঁর মোট ২০টি সন্তান জন্মগ্রহণ করে যাদের অধিকাংশই শৈশবে মারা যায়। তাঁর সন্তানদের মধ্যে মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহিল বাকি এবং ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি ও ধর্মীয় অঙ্গণে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছেন।


শিক্ষাজীবন

নিজ গৃহে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ১৭ বছর বয়সে তিনি নিজ বাড়ি থেকে গোপনে কলিকাতায় গমণ করেন উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে। সেখানে বিভিন্ন আহলেহাদীছ মাদরাসায় লেখাপড়া করার পর তিনি কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে ফাযেল পাস করেন। মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনি সুনাম কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু টাইটেল (কামেল) ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র ১৪ দিন পূর্বে মাতৃবিয়োগ ঘটলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ফলে কামিলের সার্টিফিকেট আর লাভ করতে পারেননি। পরবর্তীতে কলিকাতার "দারুল উলূম আহমাদিয়া সালাফিয়া" মাদরাসায় তিনি "কুতুবে সিত্তাহ" অধ্যয়ন করেন এবং কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি "দাওরা" সম্পন্ন করেন।


কর্মজীবন

১৯১৬ সালে কলিকাতা থেকে ফিরে দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন এবং সুনাম অর্জন করেন। সাতক্ষীরা সদরের লাবসা মাদরাসায় তিনি ২ দফায় প্রায় ২৭ বছর শিক্ষকতা করেন। অত:পর ১৯৫৬ সালে তিনি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপযেলার কাকডাঙ্গায় জীবনের শেষ স্মৃতি "কাকডাঙ্গা আহমাদিয়া সিনিয়র মাদরাসা" প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদরাসাতেই জীবনের শেষ ১২ বছর অতীবাহিত করে ১৯৬৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অত:পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা, ফাতাওয়া-মাসাইল এবং ওয়াজ-নছীহতে কালাতিপাত করেন। তিনি মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ আন্দোলনে একজন সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার জীবনে অতীবাহিত করার সুবাদে সাতক্ষীরার অধিকাংশ বয়স্ক আলেম এবং শিক্ষিতজনরা তাঁর ছাত্র। এখনও তাদের মুখে "আদর্শ শিক্ষক" হিসাবে মাওলানা আহমাদ আলীর নাম শোনা যায়।


সমাজ সংস্কার

খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, চব্বিশ পরগণা, হুগলি, বর্ধমান, প্রভৃতি অঞ্চলে আহলেহাদীছ আন্দোলনের নেতা হিসাবে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি আমৃত্যু পূর্ব-পাকিস্তান জমঈয়তে আহলেহাদীছ'-এর খুলনা-যশোর যেলা শাখার সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অত্র এলাকার মানুষ তখন কবরপুজা, পীরপুজাসহ নানা প্রকার শিরক ও বিদআতী রসম রেওয়াজে হাবুডুবু খাচ্ছিল। মাওলানা সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে এসবের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এছাড়া তামাক সেবন, বন্ধকী প্রথা, মহাজনী সূদী প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং জনস্বাস্থ্যসেবামূলক কার্যক্রমে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাঁর দাওয়াতে খুলনা, বাগেরহাটের শত শত মানুষ ইসলাম কবুল করে এবং আহলেহাদীছ আক্বীদা গ্রহণ করে। তাঁর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় ছোট-বড় ৫৫টি মাদরাসা এবং ১১টি মসজিদ নির্মিত হয়। তবে কয়েকটি বাদে অধিকাংশই বর্তমানে স্কুল কিংবা কলেজে রূপ নিয়েছে।


লেখনী

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন এবং সাহিত্যিক বুতপত্তি লাভ করেন। তিনি ছোট-বড় মোট ১৬টি বই লিখেছেন। তন্মধ্যে ১২ খানা বই তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রকাশ পায়। তাঁর রচিত "আক্বীদা মোহাম্মাদী', "বঙ্গানুবাদ খুতবা", "ছলাতুন্নবী", "কুরআন ও কলেমাখানি" প্রভৃতি বই ততকালীন ঘুণে ধরা ধর্মীয় সমাজের সংস্কারে বড় অবদান রেখেছিল।


মৃত্যু

১৯৭৬ সালের ১৯ মে দিবাগত রাত ৯.২০ মিনিটে ৯৪ বছর বয়সে তিনি নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিক গোরস্থানেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "আরাফাত" পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়- "মাওলানা আহমাদ আলী মারা গিয়েছেন কিন্তু তাঁহার ছাত্রদল ও তস্য ছাত্রমণ্ডলী, তাঁহার গঠনমূলক কর্মকাণ্ড এবং পুস্তকাদির মাধ্যমে তিনি দীর্ঘদিন সগৌরবে বাচিয়া থাকিবেন'।