home

call

email

২য় সংস্করণে সম্পাদকের নিবেদন

মানুষের নিজের সৎকর্মের পুরস্কার এবং অসৎকর্মের শাস্তি মানুষ নিজেই ভোগ করবে। মৃত্যুর সাথে সাথে তার সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার জীবদ্দশায় কৃত তিনটি নেক আমলের ছওয়াব মৃত্যুর পরেও জারী থাকে। যা তার আমলনামায় যুক্ত হয়। সে তিনটি হ’ল (১) ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ (২) এমন ইল্ম যা থেকে মানুষের কল্যাণ লাভ হয় (৩) সুসন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে’।[1] সন্তানের দো‘আ পিতা-মাতার জন্য ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ স্বরূপ। অমনিভাবে মুমিনের জন্য মুমিনের দো‘আ এবং পূর্ববর্তীদের জন্য পরবর্তীদের দো‘আ সবই ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ (হাশর ৫৯/১০)

আরও দু’টি বিষয়ের কথা ছহীহ হাদীছে পাওয়া যায়। একটি হ’ল, মাইয়েতের পক্ষ থেকে হজ্জ করা। যদি সক্ষমতা থাকে এবং যদি সে নিজের হজ্জ আগে করে থাকে’।[2] যাকে ‘হজ্জে বদল’ বা বদলী হজ্জ বলা হয়। আরেকটি হ’ল ছিয়াম রাখা। যদি সেটি মাইয়েতের মানতের ছিয়াম হয়’ (ইবনু মাজাহ হা/১৭৫৮)। অবশ্য এর বিনিময়ে উত্তরাধিকারীগণ ফিদইয়া দিতে পারেন। তা হ’ল দৈনিক একজন মিসকীনকে খাওয়ানো। যার পরিমাণ দৈনিক এক মুদ বা সিকি ছা‘ গম (অথবা চাউল)’।[3] তবে ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, لاَ يَصُومُ أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ وَلاَ يُصَلِّي أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍِِِِ ‘কেউ কারো পক্ষ থেকে ছিয়াম রাখতে পারে না বা ছালাত আদায় করতে পারে না’।[4] কারণ এগুলি দৈহিক ইবাদত। যা জীবদ্দশায় যেমন কাউকে দেওয়া যায় না, মৃত্যুর পরেও তেমনি কাউকে দেওয়া যায় না। বরং আমল যার ফল তার। আল্লাহ বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَاءَ فَعَلَيْهَا، ‘যে ব্যক্তি নেক আমল করল, সেটি তার নিজের জন্যই করল। আর যে ব্যক্তি মন্দ কর্ম করল, তার পাপ তার উপরেই বর্তাবে’ (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত ৪১/৪৬)। অতএব অন্যের কোন নেক আমল মাইয়েতের আমলনামায় যোগ হবে না। কেবল অতটুকু ব্যতীত, যেটুকু বিষয় উপরে বর্ণিত হয়েছে। 

প্রচলিত ‘কুরআন ও কলেমাখানী’ অর্থাৎ পুরা কুরআন পাঠ করে ও এক লক্ষ বার কালেমা তাইয়েবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ে মাইয়েতের উপর তার ছওয়াব বখ্শে দেওয়া বা ঈছালে ছওয়াবের প্রথা ইসলামের নামে একটি বিদ‘আতী প্রথা মাত্র। যাকে এদেশে ‘লাখ কালেমা’ বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় এর কোন অস্তিত্ব ছিল না। স্বর্ণযুগের পর ভ্রষ্টতার যুগে অমুসলিমদের দেখাদেখি এগুলি মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। অনেকে হজ্জ ও ছিয়ামের বিষয়টিকে ঈছালে ছওয়াবের দলীল হিসাবে পেশ করে থাকেন। অথচ শরী‘আতে মাল ‘হেবা’ করার দলীল আছে। কিন্তু ছওয়াব ‘হেবা’ করার দলীল নেই। যেমন বদলী হজ্জকারী বলেন, ‘লাববাইক ‘আন ফুলান’ (অমুকের পক্ষ হ’তে আমি হাযির)। এখানে যদি কেউ নিজের হজ্জ করার পরে বলে যে, আমার এই হজ্জের নেকী অমুককে দিলাম। তবে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ নিজের হজ্জের নেকী সে নিজে পাবে, অন্যে পাবে না। আর ছওয়াব হ’ল আমলের প্রতিদান মাত্র। যেমন আল্লাহ বলেন, جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘(বান্দাগণ পাবে) তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ’ (সাজদাহ ৩২/১৭)

বস্ত্ততঃ কুরআন এসেছিল জীবিতদের পথ দেখানোর জন্য (ইয়াসীন ৩৬/৭০); মৃতদের জন্য নয়। আব্দুর রহমান বিন শিবল (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, إِقْرَءُوا الْقُرْآنَ وَلاَ تَغْلُوا فِيهِ وَلاَ تَجْفُوا عَنْهُ وَلاَ تَأْكُلُوا بِهِ وَلاَ تَسْتَكْثِرُوا بِهِ- ‘তোমরা কুরআন পাঠ কর। এতে বাড়াবাড়ি করো না এবং এর তেলাওয়াত থেকে দূরে থেকো না। এর মাধ্যমে তোমরা খেয়ো না ও সম্পদ বৃদ্ধি করো না’।[5] অথচ ‘কুলখানী’ ও ‘কুরআনখানী’ প্রভৃতির মাধ্যমে কুরআন এখন আমাদের খাদ্য ও সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এতে কুরআন আমাদের জন্য শাফা‘আত করবে না। বরং লা‘নত করবে। এজন্যেই প্রবাদ বাক্য চালু হয়েছে, رُبَّ تَالٍ لِلْقُرْآنِ وَالْقُرْآنُ يَلْعَنُهُ ‘বহু কুরআন তেলাওয়াতকারী আছে, কুরআন যাদের উপর লা‘নত করে থাকে’। যেমন খারেজী চরমপন্থীদের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ وَلاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ، ‘তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না...’।[6] অর্থাৎ কুরআনের প্রকৃত মর্ম তারা অনুধাবন করবে না। ফলে কুরআন আগমনের উদ্দেশ্য বিরোধী কাজে তারা কুরআনকে ব্যবহার করবে। এ কারণেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ ‘আল্লাহ এই কিতাব দ্বারা বহু দলকে উঁচু করেন ও বহু দলকে নীচু করেন’ (মুসলিম হা/৮১৭; মিশকাত হা/২১১৫)। 

পতন যুগে মুসলিম সমাজে ইসলামের নামে বহু কিছু চালু হয়েছে। যা আদৌ ইসলামী প্রথা নয়। এ বিষয়ে মূলনীতি হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে নতুন কিছু উদ্ভাবন করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[7]


[1]. মুসলিম হা/১৬৩১; মিশকাত হা/২০৩ ‘ইলম’ অধ্যায়। এছাড়াও দ্রষ্টব্য : ইবনু মাজাহ হা/২৪২, ৩৬৬০; আহমাদ হা/১০৬১৮; মিশকাত হা/২৫৪, ২৩৫৪; ছহীহাহ হা/১৫৯৮।

[2]. আবুদাঊদ হা/১৮১১; ইবনু মাজাহ হা/২৯০৩; মিশকাত হা/২৫২৯।

[3]. বায়হাক্বী হা/৮০০৪-০৬, ৪/২৫৪, সনদ ছহীহ; হেদায়াতুর রুওয়াত হা/১৯৭৭, ২/৩৩৬ পৃ.; মির‘আত হা/২০৫৪-এর ব্যাখ্যা, ৭/৩২ পৃ.; ইরওয়া হা/১৩৯, ১/১৭০ পৃ.।

[4]. মুওয়াত্ত্বা হা/১০৬৯, পৃ. ৯৪; মিশকাত হা/২০৩৫ ‘ছওম’ অধ্যায় ‘ক্বাযা’ অনুচ্ছেদ; বায়হাক্বী হা/৮০০৪, ৪/২৫৪। 

[5]. আহমাদ হা/১৫৫৬৮; ছহীহাহ হা/৩০৫৭।

[6]. মুসলিম হা/১০৬৬ (১৫৪); সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৫৭৫ পৃ.।

[7]. মুসলিম হা/১৭১৮; বুখারী হা/২৬৯৭; মিশকাত হা/১৪০।

সূচীপত্র

কোরআন ও কালেমাখানী সমস্যা সশাধান